লিপবাম কী?
হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত উক্তি, নারীর সবচেয়ে বড় প্রসাধনী হলো তাঁর হাসি। শুষ্ক আর রুক্ষ ঠোঁটের হাসি অবশ্য হয় মলিন। ঠোঁটকে প্রাণবন্ত রাখতে দারুণ কার্যকর এক উপাদান লিপবাম। ঠোঁটের স্বাভাবিক রং ঠিক রাখা, ঠোঁট নরম রাখতে লিপবামের বিকল্প আছে কমই।
লিপবাম এক ধরনের তৈলাক্ত মলম যা আমাদের ঠোঁটকে সুরক্ষা দেয়। লিপবামে এক বিশেষ ধরনের ময়েশ্চারাইজিং উপাদান থাকে ( যেমনঃ তেল, পেট্রোলিয়াম জেলি) যা ত্বককে অতিরিক্ত পানি হারিয়ে শুষ্ক হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
লিপবামে নরম মোমের ন্যায় একধরনের বিশেষ পদার্থ যোগ করা হয় যাতে তা ঠোঁটের সাথে লেগে থাকে। লিপবাম ঠোঁটকে শুধু শুষ্ক হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষায় করে না, কিছুটা প্রতিষেধক হিসেবেও কাজ করে। এই মোমের মতো পদার্থটি লিপবামকে বর্ণহীন করে যেন চকচকে লিপষ্টিক বা লিপগ্লস থেকে তাকে আলাদা করে চেনা যায়। অনেক সময় এতে কর্পূর ও মেনথল যোগ করা হয়। ফলে লিপবাম ফেটে যাওয়া ঠোঁটে মৃদু চুলকানি ও বেদনা নাশক হিসেবে কাজ করে, ঠোঁটকে মসৃন করে এবং আনন্দদায়ক অনূভুতি দেয়।
শুধু তাই নয়, শরীরের অন্য ত্বকের মতো আমাদের ঠোঁটের-ও রোদ থেকে সুরক্ষা প্রয়োজন। লিপবামে রোদ থেকে সুরক্ষা প্রদানকারী উপাদান (SPF 30), অ্যান্টি-অক্সিডেন্টকো এনজাইম Q-10 থাকে। এছাড়াও ভিটামিন সি, ভিটামিন ই থাকে যা স্কিন ক্যান্সারের মতো রোগ থেকে ঠোঁটকে কে সুরক্ষা দেয়।
কিছু বিশেষ লিপবাম আছে যেগুলোতে পরিমিত মাত্রার অ্যান্টি এজিং উপাদান থাকে যেমন – হায়ালিউরোনিক এসিড, অ্যাটিলোকোলাজেন (ময়েশ্চারাইজার) এবং ডাইপালমিটাইল হাইড্রোক্সিপ্রলিন ( বলিরেখা দূরকারী উপাদান)। এ সকল উপাদান ঠোঁট মসৃন ও টানটান রাখে, ঠোঁটের কুঞ্চন রোধ করে।
ঠোঁটের সুরক্ষা ছাড়াও আমরা আরও নানা কাজে লিপবাম ব্যবহার করি। আমরা লিপবাম হাতের কনুঁই, পায়ের গোঁড়ালি, এলোমেলো চোখের পাতাকে নরম করতে, ও ত্বকের যে সকল অংশ দ্রুত শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে পড়ে সে সকল অংশেও ব্যবহার করি। এটি খুব সহজেই লিপষ্টিক বা লিপগ্লসের সাথে ব্যবহার করা যায়।
লিপবামের প্রকারভেদ
সময় বৃদ্ধির সাথে সাথে লিপবামের চাহিদা যেমন বেড়ে চলেছে তেমনি পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে মার্কেটে কম্পিটিশন। এজন্য বাজারে হরেক রকমের লিপবাম পাওয়া যায়। এদেরকে কয়েকভাগে বিভক্ত করা যায়।
- অ্যালোভেরা লিপবামঃ অ্যালোভেরার খোসা ফেলে ভেতরের অংশ ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে নিন। এতে ৩ চা-চামচ নারকেল তেল ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণ ফ্রিজে রেখে সহজেই লিপবাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এই লিপবাম ঠোঁট নরম করবে, পাশাপাশি ঠোঁটের কালো দাগও কমায় দ্রুত।
- রঙিন লিপবামঃ রঙিন লিপবাম তৈরির জন্য প্রয়োজন গোলাপ ফুলের পাপড়ি মিহি বাটা, বাজারে প্রচলিত পেট্রোলিয়াম জেলি, জলপাই তেল বা বাদাম তেল আর গোলাপজল। লিপবামে রং কতটা হালকা বা গাঢ় করবেন, সেটার ওপর নির্ভর করে উপাদানের পরিমাণ কম বেশি দেওয়া যেতে পারে। গোলাপের পাপড়ি বাটার সঙ্গে মিশিয়ে নিন প্রয়োজনমতো পেট্রোলিয়াম জেলি। এর সঙ্গে দিন কয়েক ফোঁটা জলপাই বা বাদাম তেল। সব শেষে গোলাপজল। যদি গাঢ় লিপবাম পছন্দ হয়, তাহলে লিপস্টিক মিশিয়ে নিন। এটি আপনার পছন্দের রঙ এর লিপবাম তৈরি করতে সাহায্য করবে। সব উপাদান মেশানো হলে খুব হালকা তাপে গলিয়ে নিন। শেষ একটি শুকনা পাত্রে ঠান্ডা করুন। ভালোভাবে জমাতে চাইলে ফ্রিজে দুই দিন রেখে দিন।
- রঙ বিহীন লিপবামঃ এতক্ষণ আমরা জেনেছি কিভাবে রঙ্গিন লিপবাম তৈরি করা যায়। এখন আমরা দেখবো কিভাবে রঙ বিহীন লিপবাম তৈরি করতে হয়। রঙ বিহীন লিপবাম তৈরি করতে প্রয়োজন হবে ১ চা-চামচ নারকেল তেল, ল্যাভেন্ডার তেল পরিমাণমতো, প্রাকৃতিক মোম ৩ চা-চামচ, আর ২টি ভিটামিন ই ক্যাপসুল। প্রথমেই একটি পাত্রে মোম গলিয়ে নিতে হবে। এবার নারকেল তেল ভালো করে মিশিয়ে নিন। অন্য একটি পাত্রে অল্প পরিমাণে পানি ফুটিয়ে নিন। আর ফুটন্ত পানির ওপর মিশ্রণের বাটি রেখে দিন। এবার ভিটামিন ই ক্যাপসুল ও কয়েক ফোঁটা ল্যাভেন্ডার তেল মিশিয়ে দিন। সব উপকরণ ভালো করে মিশলে চুলা থেকে পাত্রটি নামিয়ে ফেলুন। এখন মাইক্রোওয়েভে বা হালকা তাপে সব উপাদান আবার গলিয়ে নিন। পাত্রে ঢেলে ঠান্ডা হতে দিন এবং ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ফ্রিজে রাখুন।
লিপবামের কার্যকরীতা / উপকারিতা
ঠোঁটের সুরক্ষায় লিপবাম ব্যবহারে শুধুমাত্র শীতকালে ভীষণভাবে বেড়ে যায়। অথচ বছরজুড়েই ঠোঁট ভালো রাখতে চাইলে ব্যবহার করতে হবে লিপবাম―এ কথা অনেকেই জানেন না। কেন বছরজুড়েই লিপবাম ব্যবহার করতে হবে জেনে নিন।
- ঠোঁটের শুষ্কতা কমাতেঃ তীব্র গরমের মৌসুমে বাতাস গরম এবং কখনো কখনো খুব শুষ্ক থাকে। ফলে ঠোঁটেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। ঠোঁট হয়ে যায় রুক্ষ, শুষ্ক। ঠোঁটের সৌন্দর্যও ম্লান হয়। তাই পুরো বছরই ঠোঁটকে সুরক্ষিত রাখতে লিপবাম ব্যবহার করুন। কেননা এটি বাতাসের যেকোনো ধরনের শুষ্ক প্রভাব থেকে ঠোঁটকে রক্ষা করে।
- অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা পেতেঃ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ক্ষতি করে ঠোঁটেরও। তাই কেবল শীত নয়, বরং গ্রীষ্মেও এসপিএফ আছে এমন একটি লিপবাম রাখুন সঙ্গে। যাতে ঠোঁট সুরক্ষিত থাকে।
- আর্দ্রতা বজায় রাখতেঃ গরমের তাপ এবং বাতাসের আর্দ্রতার কারণে গ্রীষ্মে ঠোঁট শুকিয়ে যেতে পারে। লিপবাম ঠোঁটের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং যেকোনো ধরনের শুষ্কতা প্রতিরোধ করবে।
- ঠোঁটের সৌন্দর্যঃ ঠোঁট সুন্দর রাখতে কে না চায়। এ জন্য একটু তো যত্ন করা উচিত। ঠোঁট কোমল, নরম ও সুন্দর রাখতে নিয়মিত লিপবাম ব্যবহারের বিকল্প নেই।
সুতরাং, আপনার ঠোঁটের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে এবং ঠোঁটকে নমনীয় রাখতে লিপবামের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে লিপবাম তৈরির উপায়
বাজারের কেমিক্যাল যুক্ত লিপ বাম ব্যবহারের ফলে অনেক সময় ঠোঁট কালো হয়ে যায় ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ঘরেই তৈরি করতে পারেন লিপবাম। আসুন জেনে নিই কীভাবে তৈরি করবেন লিপবাম-
- দুই চামচ নারিকেল তেল, এক চা চামচ শিয়া বাটার, এক চামচ মধু, আধা চামচ বিট পাউডার, এসেনশিয়াল অয়েল এবং এক চামচ ক্যাস্টর অয়েল নিন।
- এবার একটি প্যানে নারিকেল তেল, শিয়া বাটার এবং ক্যাস্টর অয়েল গরম করে মিশিয়ে নিন।
- এই মিশ্রণটিতে মধু, বিট পাউডার এবং এসেনশিয়াল অয়েল দিন। একটি ছোট কৌটায় বা জারে রাখুন।
- তার পর এটি ফ্রিজে রাখুন। এই লিপবাম ব্যবহার করতে পারেন।
পেট্রোলিয়াম জেলি দিয়ে লিপবাম তৈরি
পেট্রোলিয়াম জেলি ঠোঁটের আর্দ্রভাব বজায় রাখে। শীতকালে ঠোঁটকে শুষ্ক হতে দেয় না। ফলে, ঠোঁট ফাটা কিংবা ঠোঁটের চামড়া ওঠার সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়। পেট্রোলিয়াম জেলি ঠোঁটকে সুরক্ষা প্রদান করে এবং হাইড্রেট রাখে।
- না চাইতেও শীতকালে ঠোঁটের খেয়াল রাখতে হয়। ঠোঁটে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিমের মোটা প্রলেপ দেওয়ার পর ঠোঁট ফেটে চৌচির হয়। আসলে ঠোঁটে যত্নে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম নয়, প্রয়োজন পেট্রোলিয়াম জেলি।
- পেট্রোলিয়াম জেলি ঠোঁটের আর্দ্রভাব বজায় রাখে। শীতকালে ঠোঁটকে শুষ্ক হতে দেয় না। ফলে, ঠোঁট ফাটা কিংবা ঠোঁটের চামড়া ওঠার সমস্যা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
- ঠোঁটের যত্নে বরাবরই পেট্রোলিয়াম জেলির কদর বেশি। লিপস্টিক থেকে শুরু করে লিপবাম তৈরিতে পেট্রোলিয়াম জেলি হল প্রধান উপাদান। পেট্রোলিয়াম জেলি ঠোঁটকে সুরক্ষা প্রদান করে এবং হাইড্রেট রাখে।
- ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকা দরকার। সাদা রঙের পেট্রোলিয়াম জেলিই ঠোঁটের জন্য আদর্শ। যে সব পেট্রোলিয়াম জেলি রঙিন হয়, তাতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান মেশানো থাকে। এগুলো ঠোঁটের জন্য উপযুক্ত নয়।
- আজকাল রঙিন লিপবাম ব্যবহারের চলই বেশি। এই ধরনের লিপবাম ব্যবহার করলে আর লিপস্টিক পরার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু ঠোঁটের জন্য এগুলো ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। তার চেয়ে বাড়িতেই লিপবাম বানিয়ে নিন।
- হাতের কাছে পেট্রোলিয়াম জেলি ও নারকেল তেল থাকলেই তৈরি হয়ে যাবে লিপবাম। ১ চামচ পেট্রোলিয়াম জেলি গলিয়ে নিন। এতে কয়েক ফোঁটা নারকেল তেল মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। মিশ্রণটি জমে গেলেই লিপবাম তৈরি।
- রঙিন লিপবাম বানাতে পারেন। বেদানার কয়েকটা দানা ছাড়িয়ে পিষে নিন। বেদানার রসের সঙ্গে নারকেল তেল ও পেট্রোলিয়াম জেলি মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। তৈরি লাল রঙের লিপবাম।
- পেট্রোলিয়াম জেলি বা নারকেল তেল ছাড়াও আপনি লিপবাম বানাতে পারেন। কয়েক টুকরো বিটরুট ব্লেন্ডারে দিয়ে রস বের করে নিন। এতে এক চামচ ঘি মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। তৈরি হয়ে যাবে লিপবাম। আয়ুর্বেদের মতে, ঘি ঠোঁটের আর্দ্রতা বজায় রাখে।
ঠোঁট মানুষের অন্যতম সৌন্দর্যের প্রতীক। কারণ, মানুষের সুন্দর হাঁসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের মাধ্যমে। আর সেই ঠোঁটের যত্ন নিতে আমরা উদাসীন থাকি। ব্যস্ততা, উদাসীনতা অথবা অলসতা যাই হোক না কেনো, ঠোঁটের যত্ন নিতে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি, হালাল, অ্যালকোহল মুক্ত আমাদের লিপবাম আপনার ঠোঁটকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে, সেই সাথে আপনার হাঁসিকে করে তোলে প্রাণবন্ত। তাহলে আর দেরি কেন এখুনি লিপবাম সংগ্রহ করুন।