কোরিয়ান বা কে-বিউটি
অনেকের কাছেই দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি বেশ আকর্ষণীয় । কেউ কেউ তাদের রূপচর্চা, ফ্যাশন থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়গুলো অনুসরণ করেন। কোরিয়ানদের স্বচ্ছ ত্বক অনেকের কাছেই বিস্ময়। তাদের রূপের রহস্য অনেকেরই অজানা।
কে-পপ, কোরিয়ান খাবার ও কে-ড্রামা বিশ্বব্যাপী দারুণ সাড়া ফেলেছে। এর সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কোরিয়ান বিউটি বা কে-বিউটি। কে-বিউটি পণ্যগুলো ত্বকের জন্য খুবই কার্যকরী। সাধারণত কোরিয়ানদের উজ্জ্বল ত্বকের জন্য সুখ্যাতি আছে। এর মূল কারণ কে-বিউটি।
বিউটি ট্রেন্ডে কোরিয়ান স্কিন কেয়ারের দৌরাত্ম্য চলছে কয়েক বছর ধরে। নতুন নতুন সব স্কিন ট্রেন্ড তৈরিতে কোরিয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। গ্লাস স্কিন, মোচি স্কিন, ক্লাউডলেস স্কিন, বিবি ক্রিম—সবকিছুই এসেছে পশ্চিম এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটি থেকে। কোরিয়ানরা বরাবরই খুব স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যসচেতন জাতি। সৌন্দর্যচর্চায় কোরিয়ানদের মূলমন্ত্র ‘স্কিন ফার্স্ট, সেকেন্ড মেকআপ’।
ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে কোরিয়ান টিপস
- নিয়মিত নিন ত্বকের যত্ন: একদিন করলেন, এক সপ্তাহ করলেন না, তা হবে না। নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেওয়া জরুরি। এর মধ্যে ক্লিনজিং, টোনিং, ময়েশ্চারাইজিং অন্যতম। মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। রাতে শোওয়ার পনেরো মিনিট আগে আপনার ত্বককে পানি দিয়ে ভালো করে ধুতে হবে। এতে ত্বক ভালো থাকবে।
- পর্যাপ্ত পানি পান: প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। কারণ কোরিয়ানরা প্রচুর পরিমাণে পানি খান। যাতে তাদের ত্বক ময়েশ্চারাইজার থাকে। শরীর যাতে কখনও ডিহাইড্রেট না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
- নিয়মিত ব্যায়াম: কোরিয়ান নারীরা ফিগার ধরে রাখতে বেশ সচেনতন। এজন্য তারা রোজ কার্ডিও, নিয়মিত ব্যায়াম করে থাকেন। ব্যায়াম শুধু স্বাস্থ্যেই ভালো রাখে তা নয়, ত্বকের জন্যও খুব উপকারী।
- খাদ্যাভ্যাসে খেয়াল রাখুন: ত্বক ভালো রাখতে খাওয়া-দাওয়ার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে আপনাকে। প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি রাখুন। কারণ শাকসবজিত পুষ্টিগুণে ভরপুর। এতে ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। কোরিয়ানরা প্রচুর পরিমাণে বাঁধাকপি খান। যা খেলে তাদের ত্বকে এমনিতেই খুব উজ্জ্বল থাকে।
- চাল ধোয়া পানি ব্যবহার: কোরিয়ান নারীরা প্রতিদিন চাল ধোয়া পানি মুখে মাখেন, অর্থাৎ চাল ধোয়ার পর সেই পানিতে ৩০ মিনিট চাল ভিজিয়ে রাখুন। এবার সেই চালের পানি একটা বোতলে ভরে রাখুন। তারপর টোনারের মতো করে আপনি সেই পানি মুখে স্প্রে করুন। এতে ত্বক খুব উজ্জ্বল থাকবে।
- অ্যালোভেরা জেল: রোজ রাতে শোওয়ার আগে অ্যালোভেরা জেল দিয়ে মুখে ম্যাসাজ করুন। কোরিয়ানরা নিয়মিত এই জেল ব্যবহার করেন। মধু ,লেবুর রস, হলুদ, অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে মুখে মাখুন। এতে মুখ উজ্জ্বল থাকবে। সপ্তাহে ১ থেকে ২ দিন এই প্যাক ব্যবহার করতে পারেন।
কোরিয়ানদের সুন্দর ত্বকের ইতিহাস
কে- পপ বা কোরিয়ান চলচ্চিত্র এবং গানের জনপ্রিয়তার কারণেই কে-বিউটি এত আলোচনায় এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে কোরিয়ানদের সৌন্দর্যের এই ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮ শতকের শেষ দিকে “কোরিয়ান বিউটি” ধারণার উৎপত্তি ঘটে। সেসময় পশ্চিমা ফ্যাশন এবং কোরিয়ান কালচারের সংমিশ্রণ হয়। এরপর ১৯ শতকের শুরুর দিকে কোরিয়ান মেকআপ এবং প্রসাধনসামগ্রীর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ১৮৮০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত এই সময়টিতে বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যের যে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তা গেয়ংসিওনশি-ডে (경서시대) নামে পরিচিত।
ত্বকের বিষয়ে কোরিয়ানদের জ্ঞান এবং দক্ষতা যথেষ্ট উন্নত। সেই ১৮ শতক থেকেই নিজেদের প্রসাধনী সামগ্রীর সাহায্যে পুরো বিশ্বের বুকে আধিপত্য বিস্তার করছে। কোরিয়ার রূপচর্চায় সাধারণত প্রাকৃতিক উপকরণ , যেমন ক্যামেলিয়া ফুল, মুগডাল, ভাত, চালধোয়া পানি, অ্যালোভেরা, মাগওয়ার্ট নির্যাস, যষ্টিমধু, বেদানা, বাঁশের নির্যাস, জিনসেং ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
কোরিয়ান মহিলাদের রূপের রহস্য
- অয়েল ক্লিনজারঃ কে-বিউটির শুরুতে মেকআপ রিমুভার হিসেবেই অয়েল ক্লিনজার ব্যবহার করা হয়। তৈলাক্ত ত্বকের জন্যও এটি কার্যকর। তবে, সাধারণত শুষ্ক ত্বকে অয়েল ক্লিনজার ব্যবহার করা হয়। অয়েল বা তেল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করায় মেকাপে থাকা ধুলা, সিবাম, এসপিএফ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। অয়েল ক্লিনজার হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করা হয়।
- ওয়াটার বেজড ক্লিনজারঃ অয়েল ক্লিনজারে যেসব উপাদাম রিমুভ করা যায় না সেগুলো রিমুভ করতে দ্বিতীয় ধাপে ওয়াটার বেজড ক্লিনজার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ভেজা ত্বকে ব্যবহার ওয়াটার বেজড ক্লিনজার ব্যবহার করা হয়। যা অয়েল ক্লিনজারের চেয়ে ত্বকের গভীরে গিয়ে পরিষ্কার করে। গ্রিনটি, চালের পানি ওয়াটার বেজড ক্লিনজারের সবচেয়ে ভালো উপাদান।
- এক্সফোলিয়েশনঃ মুখ পরিষ্কারের পর ত্বকে আটকে থাকা মৃত কোষ অপসারণে এক্সফোলিয়েশন করা হয়। সাধারণত সপ্তাহে দু’বার এক্সফোলিয়েশন করা হয়। এক্সফোলিয়েশন সপ্তাহে দু’বার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এটি ত্বকের শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়।
- টোনারঃ টোনার হলো বোটানিকাল উপাদানে সমৃদ্ধ। ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধোয়ার সময় প্রত্যেকবার টোনার ব্যবহার করা হয়। টোনার ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখে ও রক্তা চলাচল বৃদ্ধি করে এবং ত্বকের পিএইচ নিয়ন্ত্রণ রাখে। টোনার মুখের ত্বক কোমল করে।
- এসেন্সঃ এটি টোনার ও সিরামের মিশ্রণ হলো এসেন্স। এটি ত্বককে হাইড্রেট করে এবং ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে। কিন্তু, ত্বক খুব তৈলাক্ত হলে এই ধাপটি এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং দিনে একবার করায় উত্তম।
- সিরাম বা অ্যাম্পুলঃ কে-বিউটির গুরুত্বপূর্ণ ধাপ সিরাম ও অ্যাম্পুল। সিরাম ডিহাইড্রেশন, বয়সের দাগ বা বলিরেখার মতো সমস্যা দূর করে। সিরাম ও অ্যাম্পুল প্রায় একই ধরনের হয়। তবে, অ্যাম্পুল সিরামের চেয়ে ভারী হয়।
- শিট মাস্কঃ শিট মাস্ক ত্বকের জন্য আরামদায়ক। এটি খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। শিট মাস্ক ত্বক সুস্থ রাখে। এটি সব ধরণের ত্বকের জন্য উপযুক্ত। একটি মাস্ক সপ্তাহে একবার বা দুইবার ব্যবহার করা উচিত।
- আই ক্রিমঃ আমাদের চোখের চারপাশের ত্বক সূক্ষ্ম ও পাতলা হয়। তাই চোখের চারপাশে ক্রিম ব্যবহারে রিং ফিঙ্গার ব্যবহার করা ভালো। ত্বকে কোনো বলিরেখা না থাকলে আই ক্রিম এড়িয়ে চলা ভালো।
- ময়েশ্চারাইজারঃ ত্বকের যত্নে ময়েশ্চারাইজারের চেয়ে ভালো কিছুই হতে পারে না। কে-পপ রুটিনে সন্ধ্যায় ভারী নাইট ক্রিম সবচেয়ে ভালো। সকালে মেনে চললে হালকা ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। ময়েশ্চারাইজার ত্বককে পুনরুজ্জীবিত ও সুন্দর করে তোলে।
- সানস্ক্রিনঃ প্রতিদিন সানস্ক্রিন ব্যবহার করার ত্বকের জন্য খুবই উপকারি। সানস্ক্রিন ইউভিএ ও ইউভিবি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। কে-বিউটিতে ৩০+ সান প্রটেকশন ফ্যাক্টর (এসপিএফ) যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি ইউভিবি রশ্মি থেকে ৯৭ শতাংশ রক্ষা করে।